ঢাবিতে ১৫ জুলাই হামলায় ৭০ শিক্ষক ও ছাত্রলীগের ১২২ শিক্ষার্থী শনাক্ত

 


জুলাই অভ্যুত্থানে গত বছরের ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় তথ্যানুসন্ধান কমিটি ৭০ জন শিক্ষকের প্রমাণ পেয়েছে, যারা নানাভাবে হামলায় ইন্ধন জুগিয়েছেন-উস্কানি দিয়েছেন। হামলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অবহেলা খুঁজে পেয়েছে কমিটি। এছাড়া নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত ১২২ শিক্ষার্থী হামলায় প্রত্যক্ষ জড়ান।

বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) বিকেলে উপাচার্যের সভাকক্ষে উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খানের হাতে তদন্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করে কমিটি। সত্যানুসন্ধান কমিটির আহ্বায়ক আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহফুজুল হক সুপণ প্রতিবেদন হস্তান্তরের সময় এ তথ্য জানিয়েছেন।

মাহফুজুল হক সুপণ বলেন, পরিকল্পিতভাবে শিক্ষার্থীদের ওপর এ হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ হামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২২ শিক্ষার্থীকে চিহ্নিত করেছি। বহিরাগত অনেকেও হামলায় জড়িয়েছে। বিশেষত মহানগর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

তিনি আরও বলেন, উপাচার্যের বাসভবনের সামনে মেয়েদেরকে বাস থেকে নামাচ্ছে এবং পেটাচ্ছে। এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা। বিশেষত মেয়েগুলোকে ধরে ধরে পেটানো হচ্ছে। একজন মেয়ে হাত ছাড়িয়ে চলে যেতে চাচ্ছিল, তার হাত ধরে রেখেছে, এটা তো শ্লীলতাহানীর পর্যায়ে পড়ে।

হামলাকে পূর্বপরিকল্পিত উল্লেখ করে মাহফুজুল হক বলেন, ১৫ জুলাইয়ের হামলা ছিল পুরোটাই পরিকল্পিত। সেখানে দুইটি গ্রুপ ছিল সাদা ক্যাপ পরিহিত; একটি গ্রুপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মলচত্বরে, আরেকটি গ্রুপ ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের সামনে। হামলায় সরকারি বাঙলা কলেজ, কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীদেরও পাওয়া গেছে। আগে থেকে পরিকল্পনা না হলে এভাবে সম্ভব না।

কমিটির আহ্বায়ক বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টার, ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরী বিভাগের ফটকের এবং জরুরী বিভাগের ভেতরেও হামলা হয়েছে। ডাক্তারদের চিকিৎসা না দিতে বলা হয়েছে। সেসব ভিডিও আমরা পেয়েছি।

প্রতিবেদনে কমিটি জানায়, হামলার নিকৃষ্টতম দিক ছিল নারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা এবং হাসপাতালে গিয়েও হামলা করা হয় এবং ডাক্তারদের চিকিৎসাপ্রদানে বাধা প্রদান করা হয়। এটিকে তারা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন।

তদন্তের ব্যাপারে অধ্যাপক মাহফুজুল হক সুপণ জানান, তদন্তের কার্যক্রম আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে সম্পন্ন করা হয়েছে। নির্দোষ কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি। যাদের দোষী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তাদের নির্দোষ প্রমাণ করার কোনো সুযোগ নেই।

মাহফুজুল হক সুপণ বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে কোনো তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জনসম্মুখে এভাবে হস্তান্তর এটিই প্রথম। এর আগে কোনো কমিটি এমনটি করতে পারেনি। ১৯৭২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ৭৩টি খুন হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র একটি খুনের বিচার হয়েছে। বাকিগুলোর বিষয়ে তদন্ত কমিটি ঠিকমতো প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি।’

তিনি বলেন, ‘বিগত সময়ে তদন্ত কমিটিগুলোর সাফল্য না থাকায় শিক্ষার্থীরা তথ্য–উপাত্ত দিয়ে সাহায্য করতে আগ্রহ দেখায়নি। ফলে আশানুরূপ প্রমাণ হাতে আসেনি। এতে তুলনামূলক কমসংখ্যক হামলাকারীকে শনাক্ত করা গেছে। আনুমানিক হিসেবে ২৫ শতাংশ হামলাকারী চিহ্নিত হয়েছে। তবে হামলায় জড়িত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই শনাক্ত হয়েছে।’

সত্যানুসন্ধান কমিটির এ আহ্বায়ক আরও বলেন, ‘নারীদের ওপর হামলাকারী, আহতদের হামলাকারী এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারী—এ তিন ক্যাটাগরিতে হামলাকারীদের ভাগ করা হয়েছে। এ ছাড়া জড়িত যাদের ব্যাপারে সরাসরি হামলা করার প্রমাণ পাওয়া গেছে তাদের এক ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছে। আবার যারা কেবল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলাকারীদের সঙ্গে ছিল কিন্তু হামলা করেছে বলে প্রমাণ নেই তাদের এক ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছে।’

১৫ জুলাইয়ের হামলা সুপরিকল্পিত ছিল এবং প্রশাসন এ ব্যাপারে আগেই অবগত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ হামলায় প্রশাসন কোনো বাধা দেয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের পকেট গেট দিয়ে হামলাকারীদের অনেকে প্রবেশ করেছে, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের মাঠে বহিরাগত ছাত্রলীগের কর্মীরা গাড়ি পার্কিং করেছে। হল প্রশাসন এ সব জায়গায় বাধা দিতে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। হামলার সময়ে ক্যাম্পাসে নানা জায়গায় পুলিশও উপস্থিত ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের কোনো নির্দেশনা দেয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমও নিষ্ক্রিয় ছিল।’

প্রতিবেদনে চিহ্নিত হামলাকারীদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে কমিটি সুপারিশ করেছেন বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক মাহফুজুল হক। এ পর্যন্ত হামলার ঘটনায় থানায় দুটি মামলায় অনেককে আসামি করা হয়েছে। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘পুলিশ এ মামলাগুলোতে এখন পর্যন্ত একটুও আগাতে পারেনি। আমাদের অনুসন্ধান অনুযায়ী মামলা যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের অনেকেই হামলার দিন ক্যাম্পাসে ছিল না।’

তদন্ত কমিটির সদস্য উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলমোজাদ্দেদী আলফেছানি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বাইরের যারা তাদের চিহ্নিত করা হয়নি। তাদের ব্যাপারে সংগৃহীত তথ্য–উপাত্ত এবং প্রমাণগুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করেছি। বহিরাগত এ হামলাকারীদের ব্যাপারে আমরা রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের সুপারিশ করেছি। পুলিশ প্রশাসন এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে আমাদের সংগৃহীত প্রমাণগুলো দেওয়া হবে। তারা হামলাকারীদের চিহ্নিত করে যথাযথ পদক্ষেপ নিবে।’

তদন্ত কমিটির কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, ‘১৫ জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নৃশংস হামলা গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম মাইলফলক হিসেবে কাজ করেছে। এ হামলার ধারাবাহিকতায় গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। হামলাকারীদের চিহ্নিত করতে আমরা যোগ্য লোকদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করেছি। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তারা আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করে এ কাজ সম্পন্ন করেছে।’

তিনি বলেন, ‘কমিটির জমা দেওয়া এ প্রতিবেদন সিন্ডিকেটে উত্থাপন করা হবে। সিন্ডিকেটে আলোচনার ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সিন্ডিকেটে আলোচনার প্রেক্ষিতেই তদন্তে উঠে আসা সকল তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচন করা হবে।’

সত্যানুসন্ধান কমিটির সদস্যরা জানান, অনলাইন এবং অফলাইনে সহিংসতায় আক্রান্ত, আহত এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ গ্রহণ করেছেন তাঁরা। অভিযোগের সমর্থনে ভিডিও, ছবি এবং প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়ার কনটেন্টও সংগ্রহ করেছে। কমিটি বিভিন্ন দেশি–বিদেশি ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া থেকে বিভিন্ন ধরনের তথ্য সংগ্রহ করেছে। এ ছাড়া এ কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কয়েকটি এলাকায় ভাগ করে প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যও গ্রহণ করেছে। সবকিছুর সমন্বয়ে এ তদন্ত সম্পন্ন করেছেন তাঁরা।

উল্লেখ্য, গত বছরের ১৫ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের নেতা–কর্মীরা হামলা করে। এতে প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী আহত হয়। অনেক নারী শিক্ষার্থীকেও আহত করা হয়। আহতরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে গেলে সেখানেও হামলা করা হয়। ১৬ ও ১৭ জুলাই শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করা হয়। ১৭ জুলাই বিকেল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে প্রশাসন।

Comments

Popular posts from this blog

লাখ টাকারও অধিক বেতনে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিতে চাকরির সুযোগ